চলতি নোটিসঃ
রাজবাড়ী সার্কেল | একই সুতোয় গাঁথা প্রাণ | সার্কেল ফাউন্ডেশন দিচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য মাত্র এক টাকায় খাতা, এক টাকায় কলম [বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন]। রাজবাড়ী সার্কেলের সাথেই থাকুন।
  • 01920671314
  • info@rajbaricircle.com
  • ০১:২৪ অপরাহ্ন | বৃহস্পতি | ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩
জানেন কি রাজবাড়ীতে রেলপথ আসার ইতিহাস?
| ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে/রাত দুপুরে অই/ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে/ট্রেনের বাড়ি কই ?

রাজবাড়ী রেল স্টেশন একে একে পার করে ফেলেছে ১৪৮ বছর। ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার জগতি রেলস্টেশন থেকে বর্তমান রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত ট্রেন চালু করা হয় তখনকার সময় এই পথেই সহজে কলকাতা থেকে ঢাকা বা ঢাকা থেকে কলকাতা আসাযাওয়া করা যেত। কলকাতা থেকে মানুষ ট্রেনে করে জগতি স্টেশন পার হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে নামত এবং স্টিমারে পদ্মা নদী পার হয়ে ঢাকায় চলে আসত। তখন ‘কয়লা’ পুড়িয়ে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝক ঝক শব্দে স্টিম ইঞ্জিনের (বাষ্পচালিত) রেলগাড়ি এসে এই স্টেশনে থামতো, রেলগাড়ি কেমন সেটা দেখতেও আশপাশের মানুষজনের ভিড় এখানে লেগেই থাকতো। রেল স্থাপনের পর গোয়ালন্দই একমাত্র সংযোগ কেন্দ্র যেখান থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, সিলেট, আসাম, চট্রগ্রাম থেকে স্টিমারযোগে এসে রেলগাড়িতে কলিকাতা যাতায়াতের সুযোগ ঘটে। গোয়ালন্দের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। মূলতঃ রাজবাড়ী তখন গোয়ালন্দ থানা হিসেবে দুর্গাপূর, তেনাপঁচা, জামালপুর সমন্বয়ে গোয়ালন্দ ঘাট নামে পরিচিত ছিল। রেলওয়ে লোকোসেড, স্টেশন, অফিস, কলোনী, বাসস্থান সবই রাজবাড়ীতে গড়ে উঠে। রেললাইন পাংশা হতে কালুখালীর উত্তর দিয়ে সোজা গোয়ালন্দ ঘাট হিসেবে জামালপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরে ১৮৯০ সালে বর্তমান রাজবাড়ী স্টেশন থেকে পাঁচুরিয়া হয়ে গোয়ালন্দ পর্যন্ত লাইন স্থাপন করা হয়। গোয়ালন্দকে তখন বাংলার প্রবেশ পথ (Get way of Bengal) বলা হত। গোয়ালন্দের নাম ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা, কলিকাতা, দিল্লী, এমন কি সুদূর বিলেত পর্যন্ত। গোয়ালন্দের ইলিশ, পাঙ্গাস, তরমুজ, চিনি, মশলা ভারত বিখ্যাত ছিল। কলিকাতা ও দিল্লীতে গোয়ালন্দের ইলিশ ও তরমুজের হাট বসত। গোয়ালন্দে আগমন ঘটেছে দেশের নামী দামী সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদদের। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ট্রেনযোগে গোয়ালন্দ হয়ে ঢাকা গিয়েছেন কয়েকবার। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’র পেক্ষাপট এ গোয়ালন্দ। রাজবাড়ীতে আগমন ঘটেঠে তারাশঙ্কর, অবধূতের মত সাহিত্যিকের। রেলের কারণে রেল শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে উঠে এবং আগমন ঘটে এককালের বামপন্থী নেতা পশ্চিম বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুর (১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ)।

ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে রাজবাড়ীর যে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে তা রেলকে কেন্দ্র করে। প্রথমে রেল গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও ঘাটের ভাঙ্গন এবং ঘাট রাজবাড়ী শহরের অদূরে অবস্থিত হওয়ায় রেলের সকল স্থাপনা বর্তমান রাজবাড়ী শহর এলাকায় গড়ে উঠে এবং শহরের পত্তন হয়।

রাজবাড়ী জেলাতে রেললাইন আসার বিস্তারিত ইতিহাসঃ

সেই ১৮৬২ সালের কথা; ১৫ নভেম্বরে প্রথম রেলগাড়ি চলেছিলো বাংলাদেশ ভূখণ্ডে, থেমেছিলো কুষ্টিয়ায় জগতি রেলস্টেশনে। ১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জর্জ স্টিফেনসনের আবিষ্কৃত বিশ্বের প্রথম স্টিম ইঞ্জিন রেলের যাত্রা শুরু হয়। ‘লোকোমোশান নামের সেই ট্রেনটি ব্রিটেনের স্টকটন থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরের ডালিংটন পর্যন্ত গিয়েছিলো, প্রথম চালক ছিলেন জর্জ স্টিফেনসন নিজেই। ওই সময়টাতে বিশ্বজুড়েই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রেলপথের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকা ভারতও এদিক দিয়ে পিছিয়ে ছিলো না। রাজনৈতিক ও ভৌগলিক সুবিধা এবং বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে ব্রিটিশ সরকার সেই সময়েই ভারতে রেলপথ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলো।

উপমহাদেশের প্রথম রেলপথ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে

উপমহাদেশের প্রথম রেলপথ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে Image source: herritage-history

কয়েক বছর পর ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল পেনিনসুলার রেলওয়ে নামক কোম্পানির নির্মিত প্রথম যাত্রীবাহী বাষ্পচালিত ট্রেন ইঞ্জিন ভারতীয় উপমহাদেশে যাত্রা শুরু করে। মুম্বাইয়ের বোরিবন্দর থেকে থানে পর্যম্ত ৩৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় ৪০০ জন যাত্রী নিয়ে। এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৮৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেলপথ চালু করার মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রথম রেলপথের সূচনা হয়। এরপর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতার শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট পর্যন্ত ব্রডগেজ (৫ ফুট ৬ ইঞ্চি) রেলপথ চালু করে। শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট পর্যন্ত যে রেলপথ চালু করা হয়েছিলো, সেটাকে সেই বছরেই বর্ধিত করে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার (সাবেক নদীয়া) জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার দীর্ঘ করা হয়। তারপর ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতার শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়। পশ্চিম বাংলার গেদে–বাংলাদেশের দর্শনা সীমান্ত পার হয়ে সরাসরি ট্রেন এসেছিলো বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে জগতি পর্যন্ত।

ঢাকার সাথে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করার জন্য প্রায় ১০ বছর পর ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি জগতি রেলস্টেশন থেকে বর্তমান রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত ট্রেন চালু করা হয় তখনকার সময় এই পথেই সহজে কলকাতা থেকে ঢাকা বা ঢাকা থেকে কলকাতা আসাযাওয়া করা যেত। কলকাতা থেকে মানুষ ট্রেনে করে জগতি স্টেশন পার হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে নামত এবং স্টিমারে পদ্মা নদী পার হয়ে ঢাকায় চলে আসত। মূলত তৎকালীন সময়ে ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য এই অঞ্চল বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার আর কলকাতারানাঘাট রেলপথের বেশ কাছাকাছি হওয়ায় প্রথম রেল যোগাযোগ এদিক দিয়েই স্থাপন করা হয়। এরপর ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মোহিনী মিল’, যেটা ছিলো সেই সময়ের সমগ্র এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের মিল। কলকাতার সাথে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার কারণে এত বড় কাপড়ের কল এখানে চালু হতে পেরেছিলো।

কালের সাক্ষী রেলের পানির ট্যাংকি

কালের সাক্ষী রেলের পানির ট্যাংকি, ছবিঃ আজিমুল ইসলাম

রাজবাড়ি অংশে রেলপথ পাংশা থেকে কালুখালির বর্তমান স্টেশন থেকে দুই কিলোমিটার উত্তর দিয়ে বহর কালুখালি হয়ে ধাওয়াপাড়ার ঘাট বরাবর ছিল। উক্ত রেলপথ বর্তমান রাজবাড়ি শহরের উত্তর দিক দিয়ে পূর্ব পথে জামালপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এখনো কোনো কোনো স্থানে তার স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। জামালপুরই ছিল তখন গোয়ালন্দ ঘাট যাকে গ্যাঞ্জেস বন্দর বলা হত। ‘পোড়াদহ হতে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে গোয়ালন্দ পর্যন্ত যখন রেলপথ বিস্তৃত হয় ঐ সময় আমাদের বাড়ির বহরকালুখালির ঠিক মধ্যদেশ দিয়া রেললাইন যায়। আমার পিতা তখন রতনদিয়া উঠিয়া আসিলেন।’ -[আমার স্মৃতিকথা, ত্রৈলোক্যনাথ, পৃষ্ঠা৩৩ (বহর কালুখালি বর্তমান কালুখালি স্টেশন থেকে ৫ কিমি উত্তরে)]

[irp]

ত্রৈলোক্যনাথ এর স্মৃতিকথা থেকে—–

আমার জন্ম বৎসর ১৮৭৫ গ্রামের নাম বহরকালুখালি কালুখালি স্টেশন হইতে গ্রামের দূরত্ব ছিল প্রায় দুই মাইল পোড়াদহ হইতে গোয়ালন্দ রেলপথে জগতি, কুষ্টিয়া, কোর্ট, কুষ্টিয়া (পরে কুষ্টিয়ার পূর্বদিকে গড়াই নদীর ব্রিজ পাড়ে চরাইখোল নামক একটি স্টেশন হয়) তাহার পর কুমারখালি, খোকসা, পাংশা, তাহার পরেই কালুখালি পরবর্তী স্টেশন বেলগাছি, তাহার পরেই রাজবাড়ি পরে রাজবাড়ির কিছু পশ্চিমে সূর্যনগর নামক একটি স্টেশন হয় রাজা সূর্যকুমারের স্মৃতিতে রাজবাড়ির পরবর্তী স্টেশন পাঁচুরিয়া জংশন, ইহার পরেই গোয়ালন্দ ইংরেজি উচ্চারণে গোয়ালান্ডো পাঁচুরিয়া হইতে শাখা লাইন ফরিদপুরে গিয়াছে পাংশা বেলগাছি তন্মোধ্যবর্তী কালুখালি এই তিনটি স্টেশন ১৯১০ পর্যন্ত একটি সরলরেখায় অবস্থিত ছিল পরে পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে কালুখালি স্টেশনকে সরাইয়া রতনদিয়ার কাছে আনা হয় অল্পদিনের জন্য অস্থায়ী একটি লাইন করা হয় হারোয়ার উপর দিয়া কলিকাতা হইতে চাঁগা মেলে কালুখালি সাড়ে চার ঘন্টার পথ কুষ্টিয়ার পরেই কালুখালি, মেলট্রেনে মধ্যবর্তী কোনো স্টেশনেই থামিত না কালুখালি জংশন হইবার পর মেল ট্রেন কুষ্টিয়া ছাড়িয়া সোজা রাজবাড়ি গিয়া থামিত

প্রমত্ত পদ্মার ভাঙ্গনের কারণে ১৮৯০ সালে রেল পুনঃস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৮৯০ সালের ১ এপ্রিল রেল পাংশা, বর্তমান কালুখালি, বেলগাছি, সূর্যনগর, রাজবাড়ি ভায়া লোকোসেডের পশ্চিম দিয়ে উত্তর মুখী দুর্গাপুর, তেনাপচা গোয়ালন্দ ঘাট পুনঃস্থাপিত হয়। (ইস্পাতের পথ ‍পৃষ্ঠা৫১)।

কা‌লিকাপুর লোহার ব্রিজ

কা‌লিকাপুর লোহার ব্রিজ। (ইস্ট বেঙ্গল) রেলওয়ে কোম্পানি ১৮৯০ সা‌লে এ ব্রিজ‌টি নির্মান করে।

১৮৯০ এ দ্বিতীয় পর্যায়ে রেল স্থাপনকালে দলিল দস্তাবেজে গোয়ালন্দ নামকরণ হয়েছে। ১৮৯০ সালে রাজবাড়ি শহরের কেন্দ্রে রেলস্টেশন স্থাপনকালে স্টেশনকে কেন্দ্র করে পূর্বপশ্চিম, উত্তরদক্ষিণে এক থেকে দেড় কি.মি. জায়গা রেল কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ করে। রাজা সূর্যকুমার ও বাণীবহ জমিদার গীরিজাশঙ্কর মজুমদার, বাবু নারায়ণ চক্রবর্তীসহ কয়েক জোতদার ছিলেন এ জমির মালিক। স্বল্প সময়ের মধ্যে রেলওয়ে অফিসার্স কোয়ার্টারসহ স্থাপিত হয় রেলওয়ে খেলার মাঠ, এসআর হল কেন্দ্র, লোকোসেড, শ্রমিক কোয়ার্টার, বিশ্রামাগার, ইত্যাদি। ১৯৪৭ এরপর স্থাপন করা হয় রেলওয়ে কলোনী। অনেকে রেলসূত্রের চাকরিতে স্থায়ী আবাসন গড়ে তোলে। অবশ্য বর্তমান রাজবাড়ি স্টেশনটির আধুনিকীকরণ করা হয় ১৯৬০ এর দশকে। রেলের সূত্র ধরে রাজবাড়ি শহর ভিত্তি লাভ করে। রেল সূত্রে কয়লার ব্যবসায় কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রচুর লাভবান হন। তাদের মধ্যে হাজী গোলজার হোসেন অন্যতম।

১৮৯৫ সালে পাঁচুরিয়া হয়ে রেল গোয়ালন্দ ঘাট (বর্তমান গোয়ালন্দ বাজার সংলগ্ন) পর্যন্ত পুনঃস্থাপিত হয়। এরপর পাঁচুরিয়া থেকে অম্বিকাপুর (আমিরাবাদ) রেল বসে ১৮৯৯ সালে। এ সময় খানখানাপুর, বসন্তপুর রেলস্টেশন স্থাপিত হয়। রাজবাড়ি জেলার বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের বাঁশ, বেত, পাট বহনের গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৩২ সালের ১ জানুয়ারি কালুখালি থেকে ভাটিয়াপাড়া পর্যন্ত রেল স্থাপিত হয়। এ সময় রামদিয়া, বহরপুর, আড়কান্দি, স্টেশন স্থাপিত হয়। কালুখালি রেলের জংশন স্টেশনে পরিণত হয়। পরবর্তীতে গোয়ালন্দ ঘাটের মুখে পলি জমে চর পড়লে ঘাট বর্তমান দৌলতদিয়ায় স্থাপন করা হলে ১৯৭৭ সালে রেলপথ দৌলতদিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। দৌলতদিয়া পর্যন্ত রেল স্থাপনের ক্ষেত্রে আক্কাস আলী মিয়া বিশেষ ভূমিকা রাখেন। রেলপথ নির্মাণে যে বৃটিশ সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে সে কথা বলাই বাহুল্য।

রাজবাড়িতে রেল আসার পূর্বে ১৮৬১ সাল থেকে শুরু হয় গড়াই ব্রিজ নির্মাণ। মীর মশাররফ হোসেন চন্দ আরোপ করেন ‘গৌড়ী সেতু’ নামক কবিতা পুস্তিকায়। আত্মজীবনীতে তিনি গড়াই ব্রিজ নির্মাণের একটি বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। আমার জীবনীগ্রন্থে তিনি লিখেছেন——

লাহিনীপাড়ার উত্তরাংশ হইয়া পূর্বদেশগামী রেললাইন গৌড়ী নদী পাড় হইয়া গোয়ালন্দ পর্যন্ত গিয়াছে। ইংরেজি ১৮৭১ সালে সেতুবন্ধন শেষ হইয়া গাড়ি চলা আরম্ভ হইয়াছে। ভারতে চিরবিখ্যাত মহামতি লউসেও বড়লাট বাহদুর গৌরী সেতু খুলিয়াছেন। গৌরী সেতুবন্ধন সময়ে অনেক মান্যমান হিন্দু মুসলমান কেরানী, ড্রাফটসম্যান, ক্যাশিয়ার বড় বাবু সাজিয়া রেলওয়ে কোম্পানিরর অধীনে কার্য করিতেন। খাশ ইউরোপীয়ান অতি কম হইলে ২০/২৫ জন, দেশী ফিরিঙ্গী প্রায় ঐ পরিমাণ, নিগ্রো হাবসী ১০/১২ জন, কেরানীদল ৭০/৮০ জনের কম ছিল না। হাতী, ঘোড়া, বোট নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার বিস্তর ছিল। চট্রগ্রাম, শ্রীহট্র প্রভৃতি স্থানের এবং দেশীয় কুলী, হিন্দুস্থানী কর্মকার, সূত্রধর কুলী মজুরের সংখ্যার হিসেবে কঠিন। স্বর্গীয় দুর্গাচরণ গুপ্ত যাহার গুপ্ত প্রেস, গুপ্ত পঞ্জিকা বঙ্গদেশ বিখ্যাত তিনিও গৌরী সেতুবন্ধন উপলক্ষ্যে রেলওয়ে কোম্পানির বেতনভোগী হেডবাবু হইয়া কার্য করিতেন। -(মশাররফ রচনা সম্ভার, (পৃষ্ঠা৭৩)। রেলস্থাপনের কালে অনেক কোম্পানির নিকট থেকে পেয়েছে জমির ক্ষতিপূরণ মূল্য আবার অনেকের ফসলের জমি জিরেত চলে গেছে কোম্পানির হাতে।

রাজবাড়ীগামী টেন

রাজবাড়ীগামী টেন

রেল স্থাপনের পর থেকে কালুখালি একটি জংশন, রাজবাড়ি একটি শহর, গোয়ালন্দ বাংলার দ্বারপথ (Get way of Bengal) বা বৃহৎ গঞ্জ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। তখন বাংলার রাজধানী ছিল কলিকাতা। শিক্ষাদীক্ষা, যাতায়াত, ব্যবসাবাণিজ্য, সাহিত্য সংস্কৃতি সবই ছিল কলিকাতা কেন্দ্রিক। এ সময় থেকেই বাবু কালচার বলে একটি শ্রেণি বিশেষের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে যার প্রভাব এ অঞ্চলে এখনো অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়। এখনো অফিসের হেডক্লার্ককে রাজবাড়িতে অনেক অঞ্চলে বাবু বলতে শোনা যায় আর ছেলে সন্তানদের স্বাভাবিকভাবেই ডাকা হয় বাবু বলে। বস্তুত রেলের কারণে কলিকাতার সাথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। জনজীবনে রেলের গুরুত্ব এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, ১৯৪৪ সালে রেলকে নিয়ে এক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। তৎকালীন গোয়ালন্দ মহকুমার কালুখালিভাটিয়াপাড়া রেল লাইনটি কিছু প্রশাসনিক জটিলতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে ১৯৪০ সালের ৯ ডিসেম্বর কর্তৃপক্ষ ১৮ ডিসেম্বর থেকে উ্ক্ত লাইনটি বন্ধ করার এক নোটিশ জারী করে। এটা ছিল রাজবাড়ি ও ফরিদপুরের জনমানুষের জন্য এক দুঃসংবাদ। এ সময় রাজবাড়ি ও ফরিদপুরের জনসাধারণ ভারতের ভাইসরয় ও বাংলার গভর্নর এর নিকট উক্ত লাইন চালু রাখার জন্য আকুল আবেদন জানান। এ আবেদন জনজীবনে শাখা লাইনটির সার্থক ও সামাজিক গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং লাইনটি বন্ধ নাকরার দাবি রাখেন। তারা দাবিতে উল্লেখ করেন—–‘কালুখালিভাটিয়াপাড়া রেলপথ ৫২ মাইল দীর্ঘ। এলাকাবাসীও প্রায় ১০০ শত বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে এই রেলপথের দ্বারা উপকৃত হয়েছে। এখানে অন্যকোন যানবাহন নেই। লাইনটি এলাকার অধিবাসীদের নিকট ‘Life cord’ নামে চিহ্নিত। শাখা লাইনটি ঐতিহাসিক, বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব বহন করে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করা ছাড়াও এই রেলওয়ের মাধ্যমে জনগণের একটি বিরাট অংশ তাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের জন্য কাজের সূত্রে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। কর্মক্ষেত্র প্রসারের মাধ্যমে সামাজিক ক্ষেত্রে মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নতুন নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্যবসায়ী, আইন ব্যবসার সাথে যুক্ত পেশাজীবী, চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত চিকিৎসক, শিক্ষাব্রতী, বিদ্যোৎসমাজ, সরকারি কর্মচারী, কারিগর, কৃষক, দিন মজুর ছাত্র ইত্যাদি শ্রেণি। এই লাইনটি বন্ধ হয়ে গেলে উক্ত সকল শ্রেণির মানুষ বিশেষ করে চাকরিজীবীদের মধ্যে অসুবিধার সৃষ্টি হবে এবং রেলওয়ের অনুপস্থিতির কারণে জনগণের আয়ের উপরও প্রভাব পড়বে। রেলওয়ে আগমনের ফলে এ এলাকার অধিবাসীগণ উৎসাহিত হয়ে তাদের ক্ষমতা ও উপাদান এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য নিবেদন করে। যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এ অঞ্চলের অধিবাসীগণ অনেক বেশি পরিমাণে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও অন্যান্য প্রয়োজনের তাগিদে কলিকাতার উপর অনেক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।’ (পূববাংলার রেলওয়ের ইতিহাস, দীনাক সোহানী, পৃষ্ঠা২০৪,)

[irp]

রেল স্থাপনের পর গোয়ালন্দই একমাত্র সংযোগ কেন্দ্র যেখান থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, সিলেট, আসাম, চট্রগ্রাম থেকে স্টিমারযোগে এসে রেলগাড়িতে কলিকাতা যাতায়াতের সুযোগ ঘটে। গোয়ালন্দের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। গোয়ালন্দকে তখন বাংলার প্রবেশ পথ (Get way of Bengal) বলা হত। গোয়ালন্দের নাম ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা, কলিকাতা, দিল্লী, এমন কি সুদূর বিলেত পর্যন্ত। পদ্মা ও যমুনার সংযোগস্থল বলে গোয়ালন্দ ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক, মানচিত্রবিদদের নিকট পরিচিত ছিল। তদুপরি রেল স্থাপনের পর এর গুরুত্ব অধিক বৃদ্ধি পায়। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হয় ১৮৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি। এই সময়েই ইন্ডিয়ান জেনারেটর নেভিগেশন এবং রেলওয়ে কোম্পানির স্টিমার গোয়ালন্দ থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেলের যাত্রী ও মালামাল পারাপার শুরু করে। এরপর ১ জুলাই ১৮৯৫ তারিখে চাঁদপুর ঘাট স্টেশন উদ্বোধন হওয়ার পর চাঁদপুর ঘাট পর্যন্ত রেলওয়ে যাত্রী ও মালামাল পাড়াপাড় শুরু হয়। চট্রগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা, সিলেট, আসামের যাত্রী গোয়ালন্দ ঘাট দিয়ে কলিকাতায় যাতায়াত শুরু করে। কলিকাতা থেকে ঢাকা মেইল, ওয়ান আপটু ডাউন, ওয়ান আপটুআপ প্রভৃতি নামের দ্রুতগামী ট্রেন যাতায়াত করত। অষ্ট্রিচ, ইমু, কাওয়াই প্রভৃতি নামের স্টিমার ট্রেনের যাত্রী ও মালামাল বহন করত। গোয়ালন্দঢাকা, ঢাকাগোয়ালন্দ, গোয়ালন্দনারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জগোয়ালন্দ ডিব্রুগড় স্টিমারছাড়াও অন্যপথে স্টিমার গোয়ালন্দ থেকে ফরিদপুর, বরিশাল এবং খুলনা পথে কলিকাতায় যাতায়াত করত। তখন পদ্মা নদী এবং অন্যান্য নদীর অবস্থা বর্তমানের মতো অগভীর ও স্রোতহীন ছিল না। পদ্মা, গড়াই এমন কি চন্দনা নদীতে স্টিমার চলাচল করত। ‘রেলের কারণে রাজধানী কলিকাতার সাথে সংযোগ স্থাপিত হওয়ায় গোয়ালন্দ হয়ে ওঠে পূর্ববাংলার বৃহত্তম বন্দর। স্টিমার, রেলগাড়ি, অফিস, মালামাল, ব্যবসায়ী, যাত্রী, কুলীমজুরের ভীড়ে গোয়ালন্দ এক ব্যস্ত বন্দর নগরীতে পরিণত হয়। আসামের চা বাগানে কুলি প্রেরণের জন্য স্টেশনে ডিপো নির্মাণ করা হয়। এ ডিপো কুলিদের বহির্গমন ও অভিবাসনে ব্যাবহৃত হত। (পূর্ববাংলার রেলপথের ইতিহাসদিনাক সোহানীপৃ৪৭) গোয়ালন্দের ইলিশ, পাঙ্গাস, তরমুজ, চিনি, মশলা ভারত বিখ্যাত ছিল। কলিকাতা ও দিল্লীতে গোয়ালন্দের ইলিশ ও তরমুজের হাট বসত। গোয়ালন্দে আগমন ঘটেছে দেশের নামী দামী সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদদের। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ট্রেনযোগে গোয়ালন্দ হয়ে ঢাকা গিয়েছেন কয়েকবার। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’র পেক্ষাপট এ গোয়ালন্দ।

১৮৭১ সালে রাজবাড়িতে রেল আসার পর থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা পর্যন্ত শত বছরের ইতিহাস যদি গ্রহণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে এ জেলার অর্থনৈতিক, সামজিক ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে এই রেলকে কেন্দ্র করে। পাংশা, বেলগাছি, কালুখালি, রাজবাড়ি, গোয়ালন্দ, খানখানাপুর, বসন্তপুর, রামদিয়া, বালিয়াকান্দি তুলনামূলক দক্ষিণের জঙ্গল, নাড়ুয়া এবং পশ্চিমের মৃগী, সাওরাইল কশবামাঝাইল এলাকা থেকে তুলনামূলক বর্ধিষ্ণু এলাকা। এরমধ্যে রাজবাড়ি, গোয়ালন্দ, পাংশা, বেলগাছির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক বেশি।

বাংলাদেশ রেলওয়েকে মূলত দুইটি অংশে ভাগ করা হয়, একটি অংশ যমুনা নদীর পূর্ব পাশে এবং অপরটি পশ্চিম পাশে। পূর্ব পাশের অংশের দৈর্ঘ্য ১২৭৯ কিলোমিটার এবং পশ্চিম পাশের অংশের দৈর্ঘ্য ১৪২৭ কিলোমিটার। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের রূপসা নদীর পূর্ব প্রান্তের ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রূপসাবাগেরহাট ব্রডগেজ লাইন সেকশনটিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের তৃতীয় অংশ হিসেবেও ধরা হয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে দুই ধরণের রেলপথ চালু আছেব্রডগেজ এবং মিটারগেজ। দেশের পূর্বাঞ্চলে মিটার ও ব্রডগেজ উভয় ধরণের রেলপথ বিদ্যমান, অবশ্য পূর্বাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশন হতে ঢাকা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথও রয়েছে। পূর্বে ন্যারোগেজ রেলপথ চালু থাকলেও, এখন আর তা ব্যবহার হয় না।

ফটো গ্যালারী

[slider loop=”1″ transition=”crossfade” ids=”1064,1063,1062,1061,1060,1058,1056,1055,1050,1043,1041″]


তথ্য সূত্রঃ

https://bn.wikipedia.org/wiki/বাংলাদেশ_রেলওয়ে

http://www.kushtiatown.com

https://roar.media/bangla


[wpspw_recent_post_slider]

 

চলতি ইভেন্ট

অ্যাওয়ার্ড প্রদান: ১৪ জুলাই ২০২২, বৃহস্পতিবার, বিকাল ৪ ঘটিকা, স্থান: রাজবাড়ী পৌরসভা রজনীগন্ধা অ‌ডিট‌রিয়াম