ভবদিয়া, মধুরদিয়া, পাকুরিয়া, চৌবাড়িয়া, গোপীনাথদিয়া, জালদিয়া, নয়নদিয়া, আড়াবাড়িয়া, বাঘিয়া, দৌলতদিয়া, হামুরিয়া, কান্তাদিয়া, নয়নদিয়া, কুলটিয়া, গজারিয়া, আমবাড়িয়া, বোয়ালিয়া, মাসুমদিয়া, পাকাশিয়া, ভেল্লাবাড়িয়া, পাঁচবাড়িয়া, নাদুরিয়া, ডামকদিয়া, সূর্যদিয়া, ভারকুদিয়া, কলকলিয়া, পিপুল বাড়িয়া, মুকুন্দিয়া, ঘরঘরিয়া, কুলটিয়া, পাটুরিয়া, বেড়াদি, পদমদি, তেঘারিয়া, আলোকদিয়া, ভেকুলিয়া, রামদিয়া, পদমদি, লক্ষণদিয়া, পাঁচবাড়িয়া, কোলাবাড়িয়া, খালিয়া, ভারকুলিয়া, গঙ্গাসিন্দদিয়া, ধুবাড়িয়া, তেলিগাতি, কলকলিয়া, পাঁচুরিয়া, মধুরদিয়া, মাসুমদিয়া, মালিয়াট, আলোকদিয়া, হাড়োয়া, রতনদিয়া, আন্দুলিয়া, প্রেমাটিয়া, দেলুয়া, ইন্দুরদি, ভান্ডারিয়া, তেলাই, কান্তদিয়া, দৌলতাদিয়া ইত্যাদি।
দ্বীপ ও নদী সংলগ্ন এলাকাকে দি বা দিয়ারা বলা হয়। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর ফরিদপুর জেলার নদী সংলগ্ন এলাকায় নতুন ভূমি রাজস্ব আদায়ের আওতাভূক্ত করে রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। ১৮৮১ সালে দিয়ারা সার্ভেতে মোট ২৮৭৮৮ একর জমি দিয়ারা হিসেবে খাজনার আওতায় আনয়ন করা হয়। এই দিয়ারা থেকে অনেক গ্রামের নামের পরিচতি দিয়া বা দি এবং অপভ্রংশে রিয়া, লিয়া, ইত্যাদি হয়। জেলার বেশির ভাগ অঞ্চল নদীবেষ্টিত হওয়ায় নদী সংলগ্ন জেগে ওঠা ঐ সমস্ত চরদ্বীপের পরিচিতি হিসেবে ‘দি’ দিয়া, রিয়া, ইত্যাদি নামের গ্রামের উৎপত্তি ষোড়শ শপ্তদশ শতকে গড়ে ওঠে।
প্রবাহমান নদীর কিনার, বাঁক এবং বিল হাওড়ের পার্শ্বস্থ এলাকাকে কান্দা, কান্দি, কিনার বলা হয়। জেলায় অনেক নদী প্রবাহমান ছিল। বিশেষ করে পদ্মা, হড়াই, গড়াই ও চন্দনার তীরবর্তী অঞ্চলে যে সব জনপদ গড়ে ওঠে তা কান্দ, কান্দি নামে পরিচিত হয়। উড়াকান্দা, সোনাকান্দর, আড়কান্দি, বালিয়াকান্দি, তেরাইকান্দি, কালিকান্দা, শ্যামপুরকান্দি, লিকান্দা। কান্দা পরিচিতিমূলক শব্দ হলেও আড়, পাইক বালি অর্থ যেমন পাইক অর্থ পাখি, আড় অর্থ নদীর বাঁক, বালি অর্থ বেলে চর বোঝায়।
গ্রামের তিত্তি গড়ে উঠলে তা বাড়ি, বাড়িয়া, গ্রাম, নগর এসব নামে পরিচিত হতে থাকে। টেংড়াপাড়া, আড়পাড়া, গোয়ালবাড়ি, বিষ্ণুবাড়ি, পাঁচবাড়ি, চরকান্দবাড়ি, দক্ষিণবাড়ি, দক্ষিণবাঘাবাড়ি, পশ্চিমবাঘাবাড়ি, পাটকিয়াবাড়ি, আমবাড়িয়া, পাঁচবাড়িয়া, দেবনগর, কালিনগর, ভেল্লাবাড়িয়া, রায়নগর, বনগ্রাম, দন্ডগ্রাম, চৌবাড়িয়া, জাগিয়ালপাড়া, পিপুলবাড়িয়া, দেওবাড়ি, কোলানগর, ছায়েদপাড়া, হাজরাপাড়া ইত্যাদি।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ যত নদী এখন আছে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি নদী ছিল ৫০০ বা একহাজার বছর পূর্বে। নদীর বিশেষত্ব এমন যে, দীর্ঘকালে নদী ভরাট হয়ে মরে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মরা নদী দীর্ঘকালে খালে পরিণত হয়। নদীতে অনেক সময় প্রয়োজনে খাল কাটা হয়। নদী বাঁক গ্রহণ করলে কোলে পরিণত হয়। খাল সংলগ্ন অনেক গ্রামের নাম খাল, খালিয়া, কোলের পাশের গ্রাম কো বা কালিয়া বা কোলা। হাজরাখালি, কান্তখালি, খালিয়া, বেজকোলা, সুরামখোলা, হিম্মতখালি ইত্যাদি।
[irp]
নদী মরে গেলে বিল হাওড়, দহ দোহাতে পরিণত হয়। বিলমালেঙ্গা, বিলশ্যামসুন্দরপুর, বিলসারিন্দা, বিলচৈত্রা, বিলকোনা, বিলগজারিয়া, বিলজেলা, বিলরঘুয়া, বিলছালুয়া, বিলধামু, বিলটাকাপুড়া, চষাবিলা, বিলকাউলী, বিলবড়া, ইলাতেল, লবরদোহা, বাউলদোহা, মুচিদহ, বিলচড়া, মরাবিলা ইত্যাদি। রাজবাড়ি জেলার দক্ষিণাঞ্চলে অনেক সংখ্যক বিস্তৃত বিলের অস্তিত্ব ছিল। তেঢালা, গজারিয়া, পাকুড়িয়া, কাছমিয়া ইত্যাদি বিস্তৃত বিলের অঞ্চল ভর অঞ্চল বলে পরিচিত। এসব বিলের শাপলা শালুক এক সময়ে প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযের লীলাবৈচিত্র বহন করত।
গ্রাম সমাজের বিকাশের ধারায় যখন মানুষ স্থায়ী বসতি গড়ে তুলতে থাকে তখন তা বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয়ের পরিচিতিতে নামকরণ হতে থাকে। ঐসব বিষয়ের আধিক্যহেতু ঐ সকল নামে গ্রাম পরিচিতি হয়। মহিষ-মহিষবাথান, মহিষাখোলা, বেজি-বেজকোলা, গরুপালন-ঘোরপালান, হরিণধর-হরিণধারা, আখমাড়াই – আগমারাই, নিম- নিমতলা, কৈ-কৈজুরি, খলিশা-খালিশা, পাঙ্গাস-পাঙ্গাশিয়া, শোল-শৈালকাঠি, বোয়াল-বোয়ালিয়া, শিং-শিঙ্গা, ঘুঘু-ঘুঘুশালি, বাঘ-বাঘমারা, গজার-গজারিয়া, পাট-পাটবাড়িয়া, টেংড়া-টেংড়াপাড়া, আম-আমবাড়িয়া, ভেল্লা- ভেল্লাবাড়িয়া, বাঘ-বাঘাবিষ্ণুপুর, ধান- ধানুরিয়া, ঝাউগাছ-ঝাউগ্রাম, হলুদ-হলুদবাড়িয়া, মাছ-মাছপাড়া, বেত-বেতবাড়িয়া, বাওই-বাওইখোলা, আখ- আখরজানি, বড়ই-বরইচারা, সরিষা, সরিষা, শামুক-শামুকখোলা, হাতি-হাতিমোহন, বন-বনগ্রাম, ইন্দুর-ইন্দুরদি, মাগুর-মাগুরাডাঙ্গী ইত্যাদি।
গ্রামের নাম বাঘ, হরিণ, দিয়া, গ্রামের নামকরণের পেছনে এলাকার প্রাচীনত্ব নির্দেশ করে। সে সাথে একসময় বনজঙ্গলে ঘেরা রাজবাড়ি এলাকায় এসব পশুর বসবাসের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। বলা যায় সেদিন পর্যন্ত অর্থাৎ ২০০০ শতকের মাঝামাঝিতে বন্য শুকরের বসবাস ছিল বিভিন্ন এলাকায়। মীর মশাররফ হোসেন তাঁর ১২ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৮৬০ সালের দিকে যখন কুষ্টিয়া থেকে পদমদি যাতায়াত করতেন সে বর্ণনা তাঁর লেখা ‘আমার জীবনীগ্রন্থ’ এ পাই। আমার জীবনী গ্রন্থে তিনি চন্দনা নদীর তীরবর্তী বাঘের বসবাসের কথা লিখে গেছেন। যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। বাঘের অঞ্চলে হরিণের বসবাস সকল স্থানেই দেখা যায়। তাই সে সময় হরিণও এলাকায় বসবাস করত। এ ছাড়া বন্য হাতি, মহিষও বসবাস করত। রাজবাড়ি জেলার মধ্যবর্তী অঞ্চল বিশেষ করে চন্দনা নদী এলাকাই ছিল এদের বসবাসের আড্ডাখানা। কালক্রমে ওসব বন্য প্রাণী দক্ষিণে সরে গিয়ে বর্তমানে সুন্দরবনে স্থান করে নিয়েছে। পাঙ্গাস, ইলিশ, কৈ, মাগুর, শোল, বোয়াল, শিং, খলিশা এসব নামের গ্রাম মৎস্য সম্পদের প্রাচুর্যের নিদর্শন। এসব নামের সাথে গ্রামের প্রাচীনত্ব নির্দেশ করে। এ সব গ্রামের সৃষ্টি ৫০০ বৎসরের বেশি বলে ধারণা করা যায়।
ডাঙ্গা অপেক্ষাকৃত উচু ভূমি। বিস্তৃত মাঠের দিকে তাকালে দেখা যাবে সকল স্থানের ভূমি একই সমতল নয়। কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। পানির সমতল থেকে উঁচু ভূমিকে ডাঙ্গা আবার চাষযোগ্য অপেক্ষাকৃত উচু ভূমিকে ডাঙ্গী বলে। অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিতে যে সব গ্রাম উঠেছে তা ডাঙ্গা বা ডাঙ্গী দিয়ে গঠিত হোগলাডাঙ্গী বেড়াডাঙ্গা, মৃগিডাঙ্গা, বহলাডাঙ্গী ইত্যাদি গ্রামের নাম।
[wpspw_recent_post_slider]